Tuesday 27 August 2013


আমি চঞ্চল হে,

আমি সুদূরের পিয়াসি।

দিন চলে যায়, আমি আনমনে তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে--

ওগো, প্রাণে মনে আমি যে তাহার পরশ পাবার প্রয়াসী॥

ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি--

মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই সে কথা যে যাই পাশরি॥

আমি উন্মনা হে,

হে সুদূর, আমি উদাসী॥

রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায় তরুমর্মরে ছায়ার খেলায়

কী মুরতি তব নীল আকাশে নয়নে উঠে গো আভাসি।

হে সুদূর, আমি উদাসী।

ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি--

কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাশরি॥

রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1309
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1902
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
================================================
মোদের যেমন খেলা তেমনি যে কাজ জানিস নে কি ভাই।

তাই কাজকে কভু আমরা না ডরাই॥

খেলা মোদের লড়াই করা, খেলা মোদের বাঁচা মরা,

খেলা ছাড়া কিছুই কোথাও নাই॥

খেলতে খেলতে ফুটেছে ফুল, খেলতে খেলতে ফল যে ফলে,

খেলারই ঢেউ জলে স্থলে।

ভয়ের ভীষণ রক্তরাগে খেলার আগুন যখন লাগে

ভাঙাচোরা জ্ব'লে যে হয় ছাই॥

রাগ: খাম্বাজ-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1321
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1915
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
========================================
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা।

আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা ॥

কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন্‌ বনে যাই,

কোন্‌ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা ॥

কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে--

তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে।

রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,

মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি। আহা, হাহা, হা ॥

রাগ: বিভাস-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1315
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1908
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
তার হাতে ছিল হাসির ফুলের হার কত রঙে রঙ-করা।

মোর সাথে ছিল দুখের ফলের ভার অশ্রুর রসে ভরা ॥

সহসা আসিল, কহিল সে সুন্দরী 'এসো-না বদল করি'।

মুখপানে তার চাহিলাম, মরি মরি, নিদয়া সে মনোহরা ॥

সে লইল মোর ভরা বাদলের ডালা, চাহিল সকৌতুকে।

আমি লয়ে তার নব ফাগুনের মালা তুলিয়া ধরিনু বুকে।

'মোর হল জয়' যেতে যেতে কয় হেসে, দূরে চলে গেল ত্বরা।

সন্ধ্যায় দেখি তপ্ত দিনের শেষে ফুলগুলি সব ঝরা ॥

রাগ: দেশ-মল্লার
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৪ মাঘ, ১৩৩১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৭ জানুয়ারি, ১৯২৫
রচনাস্থান: দক্ষিন আমেরিকা থেকে ইতালি যাবার পথে
=========================================
কখন দিলে পরায়ে স্বপনে বরণমালা,

ব্যথার মালা ॥

প্রভাতে দেখি জেগে অরুণ মেঘে

বিদায়বাঁশরি বাজে অশ্রু-গালা

গোপনে এসে গেলে, দেখি নাই আঁখি মেলে

আঁধারে দুঃখডোরে বাঁধিলে মোরে,

ভূষণ পরালে বিরহবেদন-ঢালা।

রাগ: পিলু
তাল: ষষ্ঠী
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1337
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1931
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=======================================
রাখো রাখো রে জীবনে জীবনবল্লভে,

প্রাণমনে ধরি রাখো নিবিড় আনন্দবন্ধনে ॥

আলো জ্বালো হৃদয়দীপে অতিনিভৃত অন্তরমাঝে,

আকুলিয়া দাও প্রাণ গন্ধচন্দনে ॥


রাগ: শ্যাম কল্যাণ
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1316
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1910
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
=======================================
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে

তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে, বুকের 'পরে ॥

পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে--

নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে।

নিশিদিন এই জীবনের সুখের 'পরে দুখের 'পরে

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে।

যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে,

তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে।

যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,

তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা।

নিশিদিন এই জীবনের তৃষার 'পরে, ভুখের 'পরে

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে ॥

রাগ: বেহাগ
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৫ ফাল্গুন, ১৩২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1914
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
========================================
কার মিলন চাও বিরহী--

তাঁহারে কোথা খুঁজিছ ভব-অরণ্যে

কুটিল জটিল গহনে শান্তিসুখহীন ওরে মন ॥

দেখো দেখো রে চিত্তকমলে চরণপদ্ম বাজে-- হায়!

অমৃতজ্যোতি কিবা সুন্দর ওরে মন ॥

রাগ: শ্রী
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1316
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1909
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
==========================================
কোন্‌ খেলা যে খেলব কখন্‌ ভাবি বসে সেই কথাটাই--

তোমার আপন খেলার সাথি করো, তা হলে আর ভাবনা তো নাই ॥

শিশির-ভেজা সকালবেলা আজ কি তোমার ছুটির খেলা--

বর্ষণহীন মেঘের মেলা তার সনে মোর মনকে ভাসাই ॥

তোমার নিঠুর খেলা খেলবে যে দিন বাজবে সে দিন ভীষণ ভেরী--

ঘনাবে মেঘ, আঁধার হবে, কাঁদবে হাওয়া আকাশ ঘেরি।

সে দিন যেন তোমার ডাকে ঘরের বাঁধন আর না থাকে--

অকাতরে পরানটাকে প্রলয়দোলায় দোলাতে চাই ॥

রাগ: খাম্বাজ-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৫ ভাদ্র, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২২ অগাস্ট, ১৯২২
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: সুভাষ চৌধুরী, অনাদিকুমার দস্তিদার, শান্তিদেব ঘোষ
===========================================
নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।

যদি পণ করে থাকিস সে পণ তোমার রবেই রবে।

ওরে মন, হবেই হবে ॥

পাষাণসমান আছে পড়ে, প্রাণ পেয়ে সে উঠবে ওরে,

আছে যারা বোবার মতন তারাও কথা কবেই কবে ॥

সময় হল, সময় হল-- যে যার আপন বোঝা তোলো রে--

দুঃখ যদি মাথায় ধরিস সে দুঃখ তোর সবেই সবে।

ঘণ্টা যখন উঠবে বেজে দেখবি সবাই আসবে সেজে--

এক সাথে সব যাত্রী যত একই রাস্তা লবেই লবে ॥

রাগ: বিভাস-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
===========================================
গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ, হোথা যাস নে --

ফুলের মুধু লুটিতে গিয়ে কাঁটার ঘা খাস নে॥

হেথায় বেলা, হোথায় চাঁপা শেফালি হোথা ফুটিয়ে

ওদের কাছে মনের ব্যথা বল্‌ রে মুখ ফুটিয়ে॥

ভ্রমর কহে, "হেথায় বেলা হোথায় আছে নলিনী --

ওদের কাছে বলিব নাকো আজিও যাহা বলি নি।

মরমে যাহা গোপন আছে গোলাপে তাহা বলিব--

বলিতে যদি জ্বলিতে হয় কাঁটারই ঘায়ে জ্বলিব।'

রাগ: ভৈরবী
তাল: ঝাঁপতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1285
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1878
========================================
ও যে মানে না মানা।

আঁখি ফিরাইলে বলে, 'না, না, না।'

যত বলি 'নাই রাতি-- মলিন হয়েছে বাতি'

মুখপানে চেয়ে বলে, 'না, না, না।'

বিধুর বিকল হয়ে খেপা পবনে

ফাগুন করিছে হাহা ফুলের বনে।

আমি যত বলি 'তবে এবার যে যেতে হবে'

দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে, 'না, না, না।'

রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1316
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1909
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
===========================================
আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে।

বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে।

তোমার বুকে বাজল ধ্বনি

বিদায়গাথা, আগমনী, কত যে--

ফাল্গুনে শ্রাবণে, কত প্রভাতে রাতে॥

যে কথা রয় প্রাণের ভিতর অগোচরে

গানে গানে নিয়েছিলে চুরি করে।

সময় যে তার হল গত

নিশিশেষের তারার মতো--

শেষ করে দাও শিউলিফুলের মরণ-সাথে॥

রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1332
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1925
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
=======================================
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।

একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে ॥

যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,

যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়--

তবে পরান খুলে

ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে ॥

যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,

যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়--

তবে পথের কাঁটা

ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে ॥

যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,

যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে--

তবে বজ্রানলে

আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে ॥

রাগ: বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
=============================================
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে॥
তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।

লক্ষ্য-শূন্য লক্ষ বাসনা ছুটিছে গভীর আঁধারে,
জানি না কখন ডুবে যাবে কোন্ অকুল-গরল-পাথারে!
প্রভু, বিশ্ব-বিপদহন্তা, তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা;
তব, শ্রীচরণ তলে নিয়ে এস, মোর মত্ত-বাসনা গুছায়ে!

আছ, অনল-অনিলে, চিরনভোনীলে, ভূধরসলিলে, গহনে;
আছ, বিটপীলতায়, জলদের গায়, শশীতারকায় তপনে।
আমি, নয়নে বসন বাঁধিয়া, ব’সে, আঁধারে মরিগো কাঁদিয়া;
আমি, দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু, দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।
================================================
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে ।

তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—

সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময় ।

সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?

লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ ।

আমার চোখে তো সকলই শোভন,

সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,

বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো ।

তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—

না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত ।

ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,

হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায় ।

আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী, আয় আমার কাছে—

সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।

প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—

একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।।


রাগ: বেহাগ-খাম্বাজ-বাউল
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1287
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1881
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
=========================================

রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে--

তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,

তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে

অশ্রুজলের করুণ রাগে॥

রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,

সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে॥

যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,

রক্তে তোমার চরণ-দোলা লাগিয়ে দিয়ে।

আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে,

পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,

মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,

বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,

তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,

কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে॥

রাগ: পিলু-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৯ ফাল্গুন, ১৩৩৩
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৩ মার্চ, ১৯২৭
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
আঁখিজল মুছাইলে জননী--

অসীম স্নেহ তব, ধন্য তুমি গো,

ধন্য ধন্য তব করুণা ॥

অনাথ যে তারে তুমি মুখ তুলে চাহিলে,

মলিন যে তারে বসাইলে পাশে--

তোমার দুয়ার হতে কেহ না ফিরে

যে আসে অমৃতপিয়াসে ॥

দেখেছি আজি তব প্রেমমুখহাসি,

পেয়েছি চরণচ্ছায়া।

চাহি না আর-কিছু-- পুরেছে কামনা,


ঘুচেছে হৃদয়বেদনা ॥
রাগ: রামকেলী
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1291
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1884
স্বরলিপিকার: কাঙ্গালীচরণ সেন
=============================================
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয়।

ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়॥

হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ্‌বধূরা ধানের ক্ষেতে--

রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হা য় হা য় হায়॥

মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।

ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো খোলো দুয়ার খোলো।

আলোর হাসি উঠল জেগে ধানের শিষে শিশির লেগে--

ধরার খুশি ধরে না গো, ওই-যে উথলে, মরি হা য় হা য় হায়॥

রাগ: বিভাস-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): পৌষ, ১৩৩০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1924
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
===========================================
ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌, লাগল যে দোল।

স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।

দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥

রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে,

রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,

নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।

দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥

বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে,

প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।

মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,

পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,

মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।

দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥


রাগ: বিভাস-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1337
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1931
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
===========================================
রইল বলে রাখলে কারে, হুকুম তোমার ফলবে কবে?

তোমার টানাটানি টিঁকবে না ভাই, রবার যেটা সেটাই রবে॥

যা খুশি তাই করতে পারো গায়ের জোরে রাখ মারো;

যাঁর গায়ে সব ব্যথা বাজে তিনি যা সন সেটাই সবে।

অনেক তোমার টাকাকড়ি, অনেক দড়া অনেক দড়ি,

অনেক অশ্ব অনেক করী -- অনেক তোমার আছে ভবে।

ভাবছ হবে তুমিই যা চাও, জগৎটাকে তুমিই নাচাও,

দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে হয় না যেটা সেটাও হবে।

রাগ: বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৩ চৈত্র, ১৩১৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1909
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
==============================================
ভরা থাক্‌ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।

মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিয়ো আনি॥

বিষাদের অশ্রুজলে নীরবের মর্মতলে

গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতন বাণী॥

যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা--

নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা।

সারা দিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢালবে মনে

পরানের পদ্মবনে বিরহের বীণাপাণি॥

রাগ: বেহাগ
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৪ বৈশাখ, ১৩৩০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৭ এপ্রিল, ১৯২৩
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
============================================
লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি,

হারিয়ে গিয়েছে তোমার আখরগুলি॥

চৈত্ররজনী আজ বসে আছি একা, পুন বুঝি দিল দেখা--

বনে বনে তব লেখনীলীলার রেখা,

নবকিশলয়ে গো কোন্‌ ভুলে এল ভুলি তোমার পুরানো আখরগুলি॥

মল্লিকা আজি কাননে কাননে কত

সৌরভে-ভরা তোমারি নামের মতো।

কোমল তোমার অঙ্গুলি-ছোঁওয়া বাণী মনে দিল আজি আনি

বিরহের কোন্‌ ব্যথাভরা লিপিখানি।

মাধবীশাখায় উঠিতেছে দুলি দুলি তোমার পুরানো আখরগুলি॥

রাগ: বেহাগ
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): চৈত্র, ১৩৩২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1926
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=======================================
আমার মন বলে, 'চাই চা ই, চাই গো-- যারে নাহি পাই গো'।

সকল পাওয়ার মাঝে আমার মনে বেদন বাজে--

'নাই, না ই নাই গো'॥

হারিয়ে যেতে হবে,

আমায় ফিরিয়ে পাব তবে,

সন্ধ্যাতারা যায় যে চলে ভোরের তারায় জাগবে ব'লে--

বলে সে, 'যা ই যা ই যাই গো'॥

রাগ: বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ভাদ্র, ১৩৪০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1933
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
===========================================
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙ্গরসিকতা

একবার রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করে সুর বাঁধছিলেন , 
কথা বসাচ্ছিলেন এবং এমনিভাবে পায়চারী করতে করতে গান রচনা করছিলেন । 
গান শেষ হতেই ডাক পড়েছিল অমলা দাশের -”অমলা ও অমলা , শিগগির সে শিখে নাও , 
এক্ষুনি ভুলে যাব কিন্তু ।”

মৃনালিনী দেবী হেসে বললেন , “এমন মানুষ আর কখনো দেখেছ অমলা , 
নিজের দেওয়া সুর নিজে ভুলে যায় ।”

তৎক্ষণাৎ রবীন্দ্রনাথের সপ্রতিভ জবাব , “অসাধারণ মানুষদের সবই অসাধারণ হয় । 
ছোট বৌ চিনলে না তো ।”
===============================================
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। ( নয়নের নয়ন ! )

হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে। ( হৃদয়বিহারী ! )

বাসনার বশে মন অবিরত ধায় দশ দিশে পাগলের মতো,

স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে।

( তোমার বিরাম নাই, তুমি অবিরাম জাগিছ শয়নে স্বপনে।

তোমার নিমেষ নাই, তুমি অনিমেষ জাগিছ শয়নে স্বপনে। )

সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ, তুমি আছ তার, আছে তব স্নেহ–

নিরাশ্রয় জন পথ যার গেহ সেও আছে তব ভবনে।

( যে পথের ভিখারি সেও আছে তব ভবনে।

যার কেহ কোথাও নেই সেও আছে তব ভবনে। )

তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর, সমুখে অনন্ত জীবনবিস্তার–

কালপারাবার করিতেছ পার কেহ নাহি জানে কেমনে।

( তরী বহে নিয়ে যাও কেহ নাহি জানে কেমনে।

জীবনতরী বহে নিয়ে যাও কেহ নাহি জানে কেমনে। )

জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি, তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,

যত পাই তোমায় আরো তত যাচি– যত জানি তত জানি নে।

( জেনে শেষ মেলে না–মন হার মানে হে। )

জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর লোক-লোকান্তরে যুগ-যুগান্তর–

তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে।

( তোমার আমার মাঝে কোনো বাধা নাই ভুবনে। )

রাগ: যোগিয়া-কীর্তন
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1293
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1887

=======================================
মম মন-উপবনে চলে অভিসারে আঁধার রাতে বিরহিণী।

রক্তে তারি নূপুর বাজে রিনিরিনি॥

দুরু দুরু করে হিয়া, মেঘ ওঠে গরজিয়া,

ঝিল্লি ঝনকে ঝিনিঝিনি॥

মম মন-উপবনে ঝরে বারিধারা, গগনে নাহি শশীতারা।

বিজুলির চমকনে মিলে আলো ক্ষণে ক্ষণে,

ক্ষণে ক্ষণে পথ ভোলে উদাসিনী॥

রাগ: সাহানা
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): কার্তিক, ১৩৪১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1934
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
==========================================
যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে

জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে ॥

সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো,

আকাশ-পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে?।

অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি।

ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা তাই কি জানি!

সকালবেলা চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছ তুমি এ কি,

ঘর-ভরা মোর শূন্যতারই বুকের 'পরে ॥

রাগ: বাগেশ্রী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৩ ফাল্গুন, ১৩২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৭ মার্চ, ১৯১৪
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।

সেই স্মৃতিটুকু কভু খনে খনে যেন জাগে মনে, ভুলো না ॥

সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো-- আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো,

আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা ॥

যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে।

দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহা লগনে।

এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার--

বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না, খুলো না ॥

রাগ: পিলু
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৩০ আশ্বিন, ১৩৩৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৭ অক্টোবর, ১৯২৭
রচনাস্থান: ব্যাংকক থেকে পিনাং যাবার পথে
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=============================================
জাগরণে যায় বিভাবরী--

আঁখি হতে ঘুম নিল হরি মরি মরি॥

যার লাগি ফিরি একা একা-- আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা,

তারি বাঁশি ওগো তারি বাঁশি তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি মরি মরি॥

বাণী নাহি, তবু কানে কানে কী যে শুনি তাহা কেবা জানে।

এই হিয়াভরা বেদনাতে, বারি-ছলোছলো আঁখিপাতে,

ছায়া দোলে তারি ছায়া দোলে ছায়া দোলে দিবানিশি ধরি মরি মরি॥
রাগ: বেহাগ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১৩২৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1918
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==========================================



কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।

মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,

শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।

আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।

আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।

আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।

এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।

এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক।

দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

মাথার 'পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ॥


রাগ: কীর্তন
তাল: অর্ধঝাঁপ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৪ আষাঢ়, ১৩০৭
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৮ জুন, ১৯০০
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।

তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মন, মন রে আমার॥

যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি--

কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন, মন রে আমার॥

নদীর জলে থাকি রে কান পেতে,

কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।

মনে হয় যে পাব খুঁজি ফুলের ভাষা যদি বুঝি,

যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে মন, মন রে আমার॥

রাগ: ভৈরবী-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1321
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1915
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
=========================================
শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়।

ক্ষণে ক্ষণে শর্বরী শিহরিয়া উঠে, হায়॥

তেমনি তোমার বাণী মর্মতলে যায় হানি সঙ্গোপনে,

ধৈরজ যায় যে টুটে, হায়॥

যেমন বরষাধারায় অরণ্য আপনা হারায় বারে বারে

ঘন রস-আবরণে

তেমনি তোমার স্মৃতি ঢেকে ফেলে মোর গীতি

নিবিড় ধারে আনন্দ-বরিষণে, হায়॥

রাগ: মেঘমল্লার
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1346
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
============================================
আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা।

আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা॥

নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে--

বাজে আলো বাজে, ও ভাই হৃদয়বীণার মাঝে--

জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা॥

আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।

আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী।

মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা--

পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি--

সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা॥

রাগ: ইমন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আষাঢ়, ১৩১৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1911
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: ভীমরাও শাস্ত্রী
==============================================
চরণধ্বনি শুনি তব, নাথ, জীবনতীরে

কত নীরব নির্জনে কত মধুসমীরে ॥

গগনে গ্রহতারাচয় অনিমেষে চাহি রয়,

ভাবনাস্রোত হৃদয়ে বয় ধীরে একান্তে ধীরে ॥

চাহিয়া রহে আঁখি মম তৃষ্ঞাতুর পাখিসম,

শ্রবণ রয়েছি মেলি চিত্তগভীরে--

কোন্‌ শুভপ্রাতে দাঁড়াবে হৃদিমাঝে,

ভুলিব সব দুঃখ সুখ ডুবিয়া আনন্দনীরে ॥

রাগ: কাফি
তাল: ঝাঁপতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1314
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1908
স্বরলিপিকার: কাঙ্গালীচরণ সেন
================================================
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে

জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ॥

এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্‌ভ্রান্ত মেঘে মন চায়

মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥

মেঘমল্লার সারা দিনমান।

বাজে ঝরনার গান।

মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা-- মন চায়

মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥

রাগ: কাফি
তাল: ২ + ২ ছন্দ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1346
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
=========================================
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙ্গরসিকতা


রায় চৌধুরী একবার নতুন চশমা পরে কবিগুরুকে দেখাতে এলেন । 
চশমার কাচটা একটু নিলাভ ছিল । তাই সুধাকান্ত বাবু বললেন ,
 “সাদা কাঁচের চেয়ে রঙ্গিন কাঁচই নাকি আমার চোখের পক্ষে উপকারী ” ।
সব শুনে গুরুদেব গম্ভীরভাবে বললেন -”যাক , 
এতদিনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল । স্বয়ং ভগবান তোমাকে যে জিনিস দিতে পারেননি ,
 এখন দেখছি ডাক্তারই তোমাকে সেটা দিলেন ।
============================================

দিব কাঙালিনীর আঁচল তোমার পথে পথে বিছায়ে॥

যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু তারি ফুলে ফুলে হে অতনু,

আমার পূজা-নিবেদনের দৈন্য দিয়ো ঘুচায়ে॥

তোমার রণজয়ের অভিযানে তুমি আমায় নিয়ো,

ফুলবাণের টিকা আমার ভালে এঁকে দিয়ো দিয়ো!

আমার শূন্যতা দাও যদি সুধায় ভরি দিব তোমার জয়ধ্বনি ঘোষণ করি--

ফাল্গুনের আহ্বান জাগাও আমার কায়ে দক্ষিণবায়ে॥

রাগ: খাম্বাজ-কীর্তন
তাল: খেমটা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ফাল্গুন, ১৩৪২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
=========================================

আমার ঢালা গানের ধারা সেই তো তুমি পিয়েছিলে,

আমার গাঁথা স্বপন-মালা কখন চেয়ে নিয়েছিলে ॥

মন যবে মোর দূরে দূরে

ফিরেছিল আকাশ ঘুরে

তখন আমার ব্যথার সুরে

আভাস দিয়ে গিয়েছিলে ॥

যবে বিদায় নিয়ে যাব চলে

মিলন-পালা সাঙ্গ হলে

শরৎ-আলোয় বাদল-মেঘে

এই কথাটি রইবে লেগে--

এই শ্যামলে এই নীলিমায়

আমায় দেখা দিয়েছিলে ॥

রাগ: পিলু
তাল: ষষ্ঠী
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1332
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1925
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===============================================
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।

খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত ॥

কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে,

খুশি রই আপন মনে-- বাতাস বহে সুমন্দ ॥

সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,

শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা।

ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে,

ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ ॥


রাগ: খাম্বাজ-কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৭ চৈত্র, ১৩১৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1912
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
========================================
আজি কমলমুকুলদল খুলিল, দুলিল রে দুলিল--

মানসসরসে রসপুলকে পলকে পলকে ঢেউ তুলিল॥

গগন মগন হল গন্ধে, সমীরণ মূর্ছে আনন্দে,

গুন্‌গুন্‌ গুঞ্জনছন্দে মধুকর ঘিরি ঘিরি বন্দে--

নিখিলভুবনমন ভুলিল।

মন ভুলিল রে মন ভুলিল॥

রাগ: বাহার
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1317
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1910
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
=============================================
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।

ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥

পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে--

ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো ॥

নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা,

বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা।

পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায়, শশী, ছড়াও কী এ।

ইন্দ্রপুরীর কোন্‌ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো ॥

রাগ: পিলু
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1336
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1929
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=========================================
আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন--

আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন ॥

যখন বেলা-শেষের ছায়ায় পাখিরা যায় আপন কুলায়-মাঝে,

সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা যখন বাজে,

তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন--

আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন ॥

অনেক দিনের অনেক কথা, ব্যাকুলতা, বাঁধা বেদন-ডোরে,

মনের মাঝে উঠেছে আজ ভ'রে।

যখন পূজার হোমানলে উঠবে জ্বলে একে একে তারা,

আকাশ-পানে ছুটবে বাঁধন-হারা,

অস্তরবির ছবির সাথে মিলবে আয়োজন--

আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন ॥


রাগ: মিশ্র ভীমপলশ্রী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১৩২৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1918
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=========================================
আমার নিশীথরাতের বাদলধারা, এসো হে গোপনে

আমার স্বপনলোকে দিশাহারা ॥

ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন--

আমি চাই নে তপন, চাই নে তারা ॥

যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে নিয়ো গো, নিয়ো গো,

আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।

একলা ঘরে চুপ চুপে এসো কেবল সুরের রূপে--

দিয়ো গো, দিয়ো গো,

আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া ॥

রাগ: বেহাগ
তাল: কাহারবা-দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১৩২২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): অক্টোবর, ১৯১৫
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==========================================
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া

তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া

চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি

গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।

ভেবেছিনু কোথা তুমি স্বর্গের দেবতা,

কেমনে তোমারে কব প্রণয়ের কথা।

ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি

চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী--

কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়,

কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়।

আপনি আজিকে যবে শুধাইছ আসি,

কেমনে প্রকাশি কব কত ভালোবাসি॥


রাগ: বিলাতি ভাঙা
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1291
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1885
===========================================
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙ্গরসিকতা


একবার ভান্ডারে নামে একটি ছেলে এল শান্তি নিকেতনে । 
সে রবীন্দ্রনাথকে চেনে না । 
রবীন্দ্রনাথকে দেখেই তার কাছে ছুটে গেল এবং জোর করে তার হাতে কি যেন একটা গুজে দিল ।
একটু দুরে সৈয়দ মুজতবা আলী সমস্ত ব্যাপারটিই লক্ষ করলেন । 
কাছে আসতেই তিনি ভান্ডারেকে জিজ্ঞেস করলেন ‘ গুরুদেবকে কি দিলি ?’
ভান্ডারে বিস্ময়ের সঙ্গে উত্তর দিল -’গুরুদেব আবার কে ?
 তিনি তো একজন ফকির । 
আমি ওকে একটা আধুলি দিয়েছি । 
মা বলেছেন সাধু সন্যাসীদের দান করতে ।”
ভান্ডারে দানশীল কিন্তু শান্ত স্বভাবের নয় । 
সবাই অতিষ্ঠ এমনকি হেডমাষ্টার পর্যন্ত ।
 এক সময় ব্যাপারটি রবীন্দ্রনাথের নজরে আনা হল তিনি তো ভাল করেই জানতেন ভান্ডারেকে ।
 তাই তিনি কৌতুক মিশিয়ে বললেন ,
 “ভান্ডারে তুই সবচেয়ে ভাল ছেলে । 
তোর এই কান্ড । তুই একবার আমাকে একটা আধুলি পর্যন্ত দিয়েছিলি । 
অন্য কোন ছাত্র আমাকে কোনদিন একটা পয়সা পর্যন্ত দেয় না । 
সেই তুই কিনা গোলমাল করিস ।”
===========================================
ফুলে ফুলে ঢ'লে ঢ'লে বহে কিবা মৃদু বায়,

তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়

পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহূ কুহূ কুহূ গায়,

কি জানি কিসেরি লাগি প্রাণ করে হায় হায়!


রাগ: বিলাতি ভাঙা
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1289
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1882
স্বরলিপিকার: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী
==============================================
এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে;

আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি--

লহো লহো করুণ করে॥

যখন যাব চলে ওরা ফুটবে তোমার কোলে,

তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে

যেন আমায় স্মরণ করে॥

বউকথাকও তন্দ্রাহারা বিফল ব্যথায় ডাক দিয়ে হয় সারা

আজি বিভোর রাতে।

দুজনের কানাকানি কথা দুজনের মিলনবিহ্বলতা,

জ্যোৎস্নাধারায় যায় ভেসে যায় দোলের পূর্ণিমাতে।

এই আভাসগুলি পড়বে মালায় গাঁথা কালকে দিনের তরে

তোমার অলস দ্বিপ্রহরে॥

রাগ: ইমন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ফাল্গুন, ১৩৪৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): মার্চ, ১৯৩৯
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
============================================
পাতার ভেলা ভাসাই নীরে,

পিছন-পানে চাই নে ফিরে ॥

কর্ম আমার বোঝাই ফেলা, খেলা আমার চলার খেলা।

হয় নি আমার আসন মেলা, ঘর বাঁধি নি স্রোতের তীরে ॥

বাঁধন যখন বাঁধতে আসে

ভাগ্য আমার তখন হাসে।

ধুলা-ওড়া হাওয়ার ডাকে পথ যে টেনে লয় আমাকে--

নতুন নতুন বাঁকে বাঁকে গান দিয়ে যাই ধরিত্রীরে ॥

রাগ: পিলু-বৃন্দাবনী সারং
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): চৈত্র, ১৩৩২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1926
==========================================
গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে।

ওগো পথিক, তুমি এসে বসবে বারে বারে ॥

ঐ যে তোমার ভোরের পাখি নিত্য করে ডাকাডাকি,

অরুণ-আলোর খেয়ায় যখন এস ঘাটের পারে,

মোর প্রভাতীর গানখানিতে দাঁড়াও আমার দ্বারে ॥

আজ সকালে মেঘের ছায়া লুটিয়ে পড়ে বনে,

জল ভরেছে ঐ গগনের নীল নয়নের কোণে।

আজকে এলে নতুন বেশে তালের বনে মাঠের শেষে,

অমনি চলে যেয়ো নাকো গোপনসঞ্চারে।

দাঁড়িয়ো আমার মেঘলা গানের বাদল-অন্ধকারে ॥

রাগ: কেদার-ছায়ানট
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1322
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1916
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী
===============================================
তোমায় চেয়ে আছি বসে পথের ধারে সুন্দর হে।

জমল ধুলা প্রাণের বীণার তারে তারে সুন্দর হে ॥

নাই যে কুসুম, মালা গাঁথব কিসে! কান্নার গান বীণায় এনেছি যে,

দূর হতে তাই শুনতে পাবে অন্ধকারে সুন্দর হে ॥

দিনের পরে দিন কেটে যায় সুন্দর হে।

মরে হৃদয় কোন্‌ পিপাসায় সুন্দর হে।

শূন্য ঘাটে আমি কী-যে করি-- রঙিন পালে কবে আসবে তরী,

পাড়ি দেব কবে সুধারসের পারাবারে সুন্দর হে ॥

রাগ: ভৈরবী
তাল: ষষ্ঠী
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৬ ফাল্গুন, ১৩৩১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১০ মার্চ, ১৯২৫
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
=========================================
আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে।

এখন চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে।

জলধারার কলস্বরে সন্ধ্যাগগন আকুল করে,

ওরে, ডাকে আমায় পথের 'পরে সেই ধ্বনিতে॥

এখন বিজন পথে করে না কেউ আসা যাওয়া

ওরে, প্রেমনদীতে উঠেছে ঢেউ, উতল হাওয়া

জানি নে আর ফিরব কিনা, কার সাথে আজ হবে চিনা--

ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা তরণীতে॥

রাগ: ইমন-কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৩ ভাদ্র, ১৩১৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1909
রচনাস্থান: বোলপুর
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভীমরাও শাস্ত্রী
================================================




জানি তোমার অজানা নাহি গো কী আছে আমার মনে।

আমি গোপন করিতে চাহি গো, ধরা পড়ে দুনয়নে॥

কী বলিতে পাছে কি বলি

তাই দূরে চলে যাই কেবলই,

পথপাশে দিন বাহি গো--

তুমি দেখে যাও আঁখিকোণে কী আছে আমার মনে॥

চিরনিশীথতিমির গহনে আছে মোর পূজাবেদী--

চকিত হাসির দহনে সে তিমির দাও ভেদি।

বিজন দিবস-রাতিয়া

কাটে ধেয়ানের মালা গাঁথিয়া,

আনমনে গান গাহি গো--

তুমি শুনে যাও খনে খনে কী আছে আমার মনে॥

রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৬ ফাল্গুন, ১৩৩২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬
রচনাস্থান: আগরতলা থেকে কলকাতার পথে
স্বরলিপিকার: রমা মজুমদার
===========================================
জাগে নাথ জোছনারাতে--

জাগো, রে অন্তর, জাগো ॥

তাঁহারি পানে চাহো মুগ্ধপ্রাণে

নিমেষহারা আঁখিপাতে ॥

নীরব চন্দ্রমা নীরব তারা নীরব গীতরসে হল হারা--

জাগে বসুন্ধরা, অম্বর জাগে রে--

জাগে রে সুন্দর সাথে ॥

রাগ: বেহাগ
তাল: ধামার
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1316
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1910
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
==========================================
রুদ্রবেশে কেমন খেলা, কালো মেঘের ভ্রূকুটি!

সন্ধ্যাকাশের বক্ষ যে ওই বজ্রবাণে যায় টুটি ॥

সুন্দর হে, তোমার চেয়ে ফুল ছিল সব শাখা ছেয়ে,

ঝড়ের বেগে আঘাত লেগে ধুলায় তারা যায় লুটি ॥

মিলনদিনে হঠাৎ কেন লুকাও তোমার মাধুরী!

ভীরুকে ভয় দেখাতে চাও, একি দারুণ চাতুরী!

যদি তোমার কঠিন ঘায়ে বাঁধন দিতে চাও ঘুচায়ে,

কঠোর বলে টেনে নিয়ে বক্ষে তোমার দাও ছুটি ॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৬ ফাল্গুন, ১৩৩১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১০ মার্চ, ১৯২৫
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
যা হবার তা হবে।

যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে?।

পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে পথ যে কোথায় সেই তা জানে,

ঘর যে ছাড়ায় হাত সে বাড়ায়-- সেই তো ঘরে লবে ॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1318
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1911
স্বরলিপিকার: সুধীরচন্দ্র কর
=========================================
সখী, বহে গেল বেলা, শুধু হাসিখেলা,

এ কি আর ভালো লাগে!

আকুল তিয়াষ, প্রেমের পিয়াস,

প্রাণে কেন নাহি জাগে!

কবে আর হবে থাকিতে জীবন

আঁখিতে আঁখিতে মদির মিলন,

মধুর হুতাশে মধুর দহন,

নিত-নব অনুরাগে।

তরল কোমল নয়নের জল

নয়নে উঠিবে ভাসি।

সে বিষাদ-নীরে নিবে যাবে ধীরে

প্রখর চপল হাসি।

উদাস নিশ্বাস আকুলি উঠিবে,

আশা-নিরাশায় পরান টুটিবে,

মরমের আলো কপোলে ফুটিবে,

শরম-অরুণ-রাগে।

রাগ: বিলাবল-কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): অগ্রহায়ণ, ১২৯৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1888
রচনাস্থান: কলকাতা, দার্জিলিং
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
গান আমার যায় ভেসে যায়----

চাস্‌ নে ফিরে, দে তারে বিদায়॥

সে যে দখিনহাওয়ায় মুকুল ঝরা, ধুলার আঁচল হেলায় ভরা,

সে যে শিশির-ফোঁটার মালা গাঁথা বনের আঙিনায়॥

কাঁদন-হাসির আলোছায়া সারা অলস বেলা--

মেঘের গায়ে রঙের মায়া, খেলার পরে খেলা।

ভুলে-যাওয়ার বোঝাই ভরি গেল চলে কতই তরী--

উজান বায়ে ফেরে যদি কে রয় সে আশায়॥

রাগ: বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৮ আষাঢ়, ১৩৩২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২ জুলাই, ১৯২৫
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
============================================
দে তোরা আমায় নূতন ক'রে দে নূতন আভরণে॥

হেমন্তের অভিসম্পাতে রিক্ত অকিঞ্চন কাননভূমি,

বসন্তে হোক দৈন্যবিমোচন নব লাবণ্যধনে।

শূন্য শাখা লজ্জা ভুলে যাক পল্লব-আবরণে॥

বাজুক প্রেমের মায়ামন্ত্রে

পুলকিত প্রাণের বীণাযন্ত্রে

চিরসুন্দরের অভিবন্দনা।

আনন্দচঞ্চল নৃত্য অঙ্গে অঙ্গে বহে যাক হিল্লোলে হিল্লোলে,

যৌবন পাক সম্মান বাঞ্ছিতসম্মিলনে॥

রাগ: ভৈরবী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ফাল্গুন ১৩৪২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
============================================
একি আকুলতা ভুবনে! একি চঞ্চলতা পবনে॥

একি মধুরমদির রসরাশি আজি শূন্যতলে চলে ভাসি,

ঝরে চন্দ্রকরে একি হাসি, ফুল- গন্ধ লুটে গগনে॥

একি প্রাণভরা অনুরাগে আজি বিশ্বজগতজন জাগে,

আজি নিখিল নীলগগনে সুখ- পরশ কোথা হতে লাগে।

সুখে শিহরে সকল বনরাজি, উঠে মোহনবাঁশরি বাজি,

হেরো পূর্ণবিকশিত আজি মম অন্তর সুন্দর স্বপনে॥

রাগ: বাহার
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৬ কার্তিক, ১৩০২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1895
রচনাস্থান: জোড়াসাঁকো
স্বরলিপিকার: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী
===========================================
চৈত্রপবনে মন চিত্তবনে বাণীমঞ্জরী সঞ্চলিতা

ওগো ললিতা

যদি বিজনে দিন বহে যায় খর তপনে ঝরে পড়ে হায়

অনাদরে হবে ধূলিদলিতা

ওগো ললিতা ॥

তোমার লাগিয়া আছি পথ চাহি-- বুঝি বেলা আর নাহি নাহি।

বনছায়াতে তারে দেখা দাও, করুণ হাতে তুলে নিয়ে যাও--

কণ্ঠাহারে করো সঙ্কলিতা

ওগো ললিতা ॥

রাগ: কাফি-খাম্বাজ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1332
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1925
===========================================
আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে--

এই নিরালায় রব আপন কোণে।

যাব না এই মাতাল সমীরণে ॥

আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥

রাগ: বেহাগ
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২২ চৈত্র, ১৩২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1914
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==============================================
শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।

কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।

উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।

দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুন্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ

ঘন ঘন রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌ রিম্‌ ঝিম্‌ বরখত নীরদপুঞ্জ।

শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।

কহ রে সজনী, এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান

দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত সকরুণ রাধা নাম।

মোতিম হারে বেশ বনা দে, সীঁথি লগা দে ভালে।

উরহি বিলুন্ঠিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পকমালে।

গহন রয়নমে ন যাও, বালা, নওলকিশোরক পাশ।

গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব, কহে ভানু তব দাস।

রাগ: পিলু-মল্লার
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১২৮৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1878
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==============================================
এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়।

শালের বনে খ্যাপা হাওয়া, এই তো আমার মনকে মাতায়।

রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে হাটের পথিক চলে ধেয়ে,

ছোটো মেয়ে ধুলায় বসে খেলার ডালি একলা সাজায়--

সামনে চেয়ে এই যা দেখি চোখে আমার বীণা বাজায়॥



আমার এ যে বাঁশের বাঁশি, মাঠের সুরে আমার সাধন।

আমার মনকে বেঁধেছে রে এই ধরণীর মাটির বাঁধন।

নীল আকাশের আলোর ধারা পান করেছে নতুন যারা

সেই ছেলেদের চোখের চাওয়া নিয়েছি মোর দু চোখ পুরে--

আমার বীণায় সুর বেঁধেছি ওদের কচি গলার সুরে॥



দূরে যাবার খেয়াল হলে সবাই মোরে ঘিরে থামায়--

গাঁয়ের আকাশ সজনে ফুলের হাতছানিতে ডাকে আমায়।

ফুরায় নি, ভাই, কাছের সুধা, নাই যে রে তাই দূরের ক্ষুধা--

এই-যে এ-সব ছোটোখাটো পাই নি এদের কূলকিনারা।

তুচ্ছ দিনের গানের পালা আজও আমার হয় নি সারা ॥



লাগল ভালো, মন ভোলালো, এই কথাটাই গেয়ে বেড়াই--

দিনে রাতে সময় কোথা, কাজের কথা তাই তো এড়াই।

মজেছে মন, মজল আঁখি-- মিথ্যে আমায় ডাকাডাকি--

ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো--

আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই নে হতে আরো বড়ো ॥

রাগ: বাউল
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৬ চৈত্র, ১৩২২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৮ এপ্রিল, ১৯১৬
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
========================================
বলো সখী, বলো তারি নাম

আমার কানে কানে

যে-নাম বাজে তোমার বীণার

তানে তানে॥

বসন্তবাতাসে বনবীথিকায়

সে-নাম মিলে যাবে,

বিরহীবিহঙ্গকলগীতিকায়

সে নাম মদির হবে যে বকুলঘ্রাণে॥

নাহয় সখীদের মুখে মুখে

সে নাম দোলা খাবে সকৌতুকে।

পূর্ণিমারাতে একা যবে

অকারণে মন উতলা হবে

সে-নাম শুনাইব গানে গানে॥

রাগ: বেহাগ
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1345
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
=========================================
আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে।

নয়নের জল ঝরিছে বিফল নয়নে॥

এ বেশভূষণ লহো সখী, লহো, এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ--

এমন যামিনী কাটিল বিরহশয়নে॥

আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে এসেছি,

বহি বৃথা মন-আশা এত ভালোবাসা বেসেছি।

শেষে নিশিশেষে বদন মলিন, ক্লান্তচরণ, মন উদাসীন,

ফিরিয়া চলেছি কোন্‌ সুখহীন ভবনে॥

ওগো ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া কী হবে মিছে আর।

যদি যেতে হল হায় প্রাণ কেন চায় পিছে আর।

কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো রজনীপ্রভাতে বসে রব কত--

এবারের মতো বসন্ত গত জীবনে॥

রাগ: ভৈরবী-কীর্তন
তাল: রূপকড়া
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৬ আষাঢ়, ১৩০০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২৯ জুন, ১৮৯৩
রচনাস্থান: শিলাইদহ
==============================================
আমার মনের মাঝে যে গান বাজে শুনতে কি পাও গো

আমার চোখের 'পরে আভাস দিয়ে যখনি যাও গো ॥

রবির কিরণ নেয় যে টানি ফুলের বুকের শিশিরখানি,

আমার প্রাণের সে গান তুমি তেমনি কি নাও গো ॥

আমার উদাস হৃদয় যখন আসে বাহির-পানে

আপনাকে যে দেয় ধরা সে সকলখানে।

কচি পাতা প্রথম প্রাতে কী কথা কয় আলোর সাথে,

আমার মনের আপন কথা বলে যে তাও গো ॥
রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা বা খেমটা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1328
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1921
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================


Thursday 22 August 2013


স্বপন-পারের ডাক শুনেছি, জেগে তাই তো ভাবি--

কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি॥

নয় তো সেথায় যাবার তরে, নয় কিছু তো পাবার তরে,

নাই কিছু তার দাবি--

বিশ্ব হতে হারিয়ে গেছে স্বপ্নলোকের চাবি॥

চাওয়া-পাওয়ার বুকের ভিতর না-পাওয়া ফুল ফোটে,

দিশাহারা গন্ধে তারি আকাশ ভরে ওঠে।

খুঁজে যারে বেড়াই গানে, প্রাণের গভীর অতল-পানে

যে জন গেছে নাবি,

সেই নিয়েছে চুরি করে স্বপ্নলোকের চাবি॥

রাগ: কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৯ বৈশাখ, ১৩৩৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২২ এপ্রিল, ১৯২৮
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
=======================================
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,

চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,

মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে--

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।



যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,

কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা,

ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,

শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়--

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।



তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,

কাটবে দিন কাটবে,

কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে, আহা,

ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সে দিন উঠবে ভরি--

চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।



তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি-- আহা,

নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে॥

রাগ: বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৫ চৈত্র, ১৩২২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৭ এপ্রিল, ১৯১৬
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
বেদনা কী ভাষায় রে

মর্মে মর্মরি গুঞ্জরি বাজে॥

সে বেদনা সমীরে সমীরে সঞ্চারে,

চঞ্চল বেগে বিশ্বে দিল দোলা ॥

দিবানিশা আছি নিদ্রাহারা বিরহে

তব নন্দনবন-অঙ্গনদ্বারে,

মনোমোহন বন্ধু--

আকুল প্রাণে

পারিজাতমালা সুগন্ধ হানে॥


রাগ: আশাবরী (দক্ষিণী)
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1337
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1931
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==============================================
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।

মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,

শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।

আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।

আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।

আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।

এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।

এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক।

দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

মাথার 'পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ॥


রাগ: কীর্তন
তাল: অর্ধঝাঁপ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৪ আষাঢ়, ১৩০৭
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৮ জুন, ১৯০০
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
তুমি কোন্‌ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।

আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে॥

আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে,

বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে॥

তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার, মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে--

ছিন্ন যবে হল তার ফেলে গেলে ভূমি-'পরে।

নীরব তাহারি গান আমি তাই জানি তোমারি দান--

ফেরে সে ফাল্গুন-হাওয়ায়-হাওয়ায় সুরহারা মূর্ছনাতে॥

রাগ: কাফি-কানাড়া
তাল: ২ + ২ ছন্দ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৭ আষাঢ়, ১৩৪৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১২ জুলাই, ১৯৩৯
রচনাস্থান: শ্রীনিকেতন
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
==========================================
তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ

ও মোর ভালোবাসার ধন।

দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

ওগো তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার চিরকালের--

ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি ভয়ে কাঁপে মন--

প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।

তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে,

ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২০ ফাল্গুন, ১৩২১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৩ মার্চ, ১৯১৫
রচনাস্থান: সুরুল
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
==============================================
সেই ভালো সেই ভালো, আমারে নাহয় না জানো।

দূরে গিয়ে নয় দুঃখ দেবে, কাছে কেন লাজে লাজানো ॥

মোর বসন্তে লেগেছে তো সুর, বেণুবনছায়া হয়েছে মধুর--

থাক-না এমনি গন্ধে-বিধুর মিলনকুঞ্জ সাজানো।

গোপনে দেখেছি তোমার ব্যাকুল নয়নে ভাবের খেলা।

উতল আঁচল, এলোথেলো চুল, দেখেছি ঝড়ের বেলা।

তোমাতে আমাতে হয় নি যে কথা মর্মে আমার আছে সে বারতা--

না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা আমার বাঁশিটি বাজানো ॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): চৈত্র, ১৩৩২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1926
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=============================================
যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।

কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম॥

কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে, ফিরি আমি কাহার পিছে--

সব যেন মোর বিকিয়েছে, পাই নি তাহার দাম॥

এই বেদনার ধন সে কোথায় ভাবি জনম ধ'রে।

ভুবন ভরে আছে যেন, পাই নে জীবন ভরে।

সুখ যারে কয় সকল জনে বাজাই তারে ক্ষণে ক্ষণে--

গভীর সুরে "চাই নে' "চাই নে' বাজে অবিশ্রাম॥

রাগ: রামকেলী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১২ ফাল্গুন, ১৩২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৪
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
========================================
ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্‌গুনিয়ে।

আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥

আলোতে কোন্‌ গগনে মাধবী জাগল বনে,

এল সেই ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে।

সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।

কেমনে রহি ঘরে, মন যে কেমন করে,

কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।

কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে,

বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে।

আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥

রাগ: কালাংড়া
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আষাঢ়, ১৩১৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1911
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
============================================
তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি।

কেউ কি তা জানে॥

তোমার আছে গানে গানে গাওয়া,

আমার কেবল চোখে চোখে চাওয়া--

মনে মনে মনের কথাখানি বলে এসেছি কেউ কি তা জানে॥

ওদের নেশা তখন ধরে নাই,

রঙিন রসে প্যালা ভরে নাই।

তখনো তো কতই আনাগোনা,

নতুন লোকের নতুন চেনাশোনা--

ফিরে ফিরে ফিরে-আসার আশা দ'লে এসেছি কেউ কি তা জানে॥

রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৬ ফাল্গুন, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১০ মার্চ, ১৯২৩
রচনাস্থান: লক্ষ্নৌ (বোম্বাই যাবার পথে)
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
তার হাতে ছিল হাসির ফুলের হার কত রঙে রঙ-করা।

মোর সাথে ছিল দুখের ফলের ভার অশ্রুর রসে ভরা ॥

সহসা আসিল, কহিল সে সুন্দরী 'এসো-না বদল করি'।

মুখপানে তার চাহিলাম, মরি মরি, নিদয়া সে মনোহরা ॥

সে লইল মোর ভরা বাদলের ডালা, চাহিল সকৌতুকে।

আমি লয়ে তার নব ফাগুনের মালা তুলিয়া ধরিনু বুকে।

'মোর হল জয়' যেতে যেতে কয় হেসে, দূরে চলে গেল ত্বরা।

সন্ধ্যায় দেখি তপ্ত দিনের শেষে ফুলগুলি সব ঝরা ॥

রাগ: দেশ-মল্লার
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৪ মাঘ, ১৩৩১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৭ জানুয়ারি, ১৯২৫
রচনাস্থান: দক্ষিন আমেরিকা থেকে ইতালি যাবার পথে
============================================
গোপন কথাটি রবে না গোপনে,

উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।

না না না, রবে না গোপনে॥

বিভল হাসিতে

বাজিল বাঁশিতে,

স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে--

না না না, রবে না গোপনে॥

মধুপ গুঞ্জরিল,

মধুর বেদনায় আলোক-পিয়াসি

অশোক মুঞ্জরিল।

হৃদয়শতদল

করিছে টলমল

অরুণ প্রভাতে করুণ তপনে।

না না না, রবে না গোপনে॥
রাগ: কালাংড়া
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1345
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
==========================================
তার বিদায়বেলার মালাখানি আমার গলে রে

দোলে দোলে বুকের কাছে পলে পলে রে॥

গন্ধ তাহার ক্ষণে ক্ষণে জাগে ফাগুনসমীরণে

গুঞ্জরিত কুঞ্জতলে রে॥

দিনের শেষে যেতে যেতে পথের 'পরে

ছায়াখানি মিলিয়ে দিল বনান্তরে।

সেই ছায়া এই আমার মনে, সেই ছায়া ওই কাঁপে বনে,

কাঁপে সুনীল দিগঞ্চলে রে॥

রাগ: ভীমপলশ্রী-মূলতান
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ভাদ্র, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1922
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=============================================
যখন এসেছিলে অন্ধকারে

চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে॥

হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম অনুভবে--

গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে॥

তুমি গেলে যখন একলা চলে

চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।

তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার পড়ে আছে--

বুঝেছিলেম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে॥

রাগ: পিলু-বারোয়াঁ
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৬ পৌষ, ১৩৩০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১ জানুয়ারি, ১৯২৪
রচনাস্থান: শ্রীনিকেতন
===========================================
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে

আমার নামটি লিখো-- তোমার

মনের মন্দিরে।

আমার পরানে যে গান বাজিছে

তাহার তালটি শিখো-- তোমার

চরণমঞ্জীরে॥

ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে

আমার মুখর পাখি-- তোমার

প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥

মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো

আমার হাতের রাখী-- তোমার

কনককঙ্কণে॥

আমার লতার একটি মুকুল

ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-- তোমার

অলকবন্ধনে।

আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে

একটি বিন্দু এঁকো-- তোমার

ললাটচন্দনে।

আমার মনের মোহের মাধুরী

মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-- তোমার

অঙ্গসৌরভে।

আমার আকুল জীবনমরণ

টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো-- তোমার

অতুল গৌরবে॥


রাগ: কীর্তন
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৮ আশ্বিন, ১৩০৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1897
রচনাস্থান: সাজাদপুর
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
============================================