Thursday 22 August 2013

 আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান

তার বদলে আমি চাই নে কোনো দান ॥

ভুলবে সে গান যদি নাহয় যেয়ো ভুলে

উঠবে যখন তারা সন্ধ্যসাগরকূলে,

তোমার সভায় যবে করব অবসান

এই ক'দিনের শুধু এই ক'টি মোর তান ॥

তোমার গান যে কত শুনিয়েছিলে মোরে

সেই কথাটি তুমি ভুলবে কেমন করে?

সেই কথাটি, কবি, পড়বে তোমার মনে

বর্ষামুখর রাতে, ফাগুন-সমীরণে--

এইটুকু মোর শুধু রইল অভিমান

ভুলতে সে কি পার ভুলিয়েছ মোর প্রাণ ॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): বৈশাখ ১৩২৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1918
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।

মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,

শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।

আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।

আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।

আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।

এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।

এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক।

দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

মাথার 'পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ॥


রাগ: কীর্তন
তাল: অর্ধঝাঁপ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৪ আষাঢ়, ১৩০৭
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৮ জুন, ১৯০০
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
বঁধু, মিছে রাগ কোরো না, কোরো না।

মম মন বুঝে দেখো মনে মনে--মনে রেখো, কোরো করুণা॥

পাছে আপনারে রাখিতে না পারি

তাই কাছে কাছে থাকি আপনারি--

মুখে হেসে যাই, মনে কেঁদে চাই--সে আমার নহে ছলনা॥

দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ,

ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ--

পলকের পরে থাকে বুক ভ'রে চিরজনমের বেদনা।

তারি মাঝে কেন এত সাধাসাধি,

অবুধ আঁধারে কেন মরি কাঁদি--

দূর হতে এসে ফিরে যাই শেষে বহিয়া বিফল বাসনা॥


রাগ: মিশ্র ঝিঁঝিট
তাল: ঝাঁপতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১০ আশ্বিন, ১৩০৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1897
রচনাস্থান: পতিসর
========================================
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।

ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥

পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে--

ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো ॥

নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা,

বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা।

পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায়, শশী, ছড়াও কী এ।

ইন্দ্রপুরীর কোন্‌ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো ॥

রাগ: পিলু
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1336
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1929
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=============================================
আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন--

আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন ॥

যখন বেলা-শেষের ছায়ায় পাখিরা যায় আপন কুলায়-মাঝে,

সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা যখন বাজে,

তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন--

আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন ॥

অনেক দিনের অনেক কথা, ব্যাকুলতা, বাঁধা বেদন-ডোরে,

মনের মাঝে উঠেছে আজ ভ'রে।

যখন পূজার হোমানলে উঠবে জ্বলে একে একে তারা,

আকাশ-পানে ছুটবে বাঁধন-হারা,

অস্তরবির ছবির সাথে মিলবে আয়োজন--

আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন ॥


রাগ: মিশ্র ভীমপলশ্রী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১৩২৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1918
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে

ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে॥

বাদলপ্রাতের উদাস পাখি ওঠে ডাকি।

বনের গোপন শাখে শাখে, পিছু ডাকে॥

ভরা নদী ছায়ার তলে ছুটে চলে--

খোঁজে কাকে, পিছু ডাকে।

আমার প্রাণের ভিতর সে কে থেকে থেকে

বিদায়প্রাতের উতলাকে পিছু ডাকে॥


রাগ: আশাবরী-ভৈরবী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ভাদ্র, ১৩৩০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1923
===========================================
সে দিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই--

ফিরে ফিরে চলে গেলে তাই॥

তখনো খেলার বেলা-- বনে মল্লিকার মেলা,

পল্লবে পল্লবে বায়ু উতলা সদাই॥

আজি এল হেমন্তের দিন

কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন।

বেলা আর নাই বাকি, সময় হয়েছে নাকি--

দিনশেষে দ্বারে বসে পথপানে চাই।

রাগ: বেহাগ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1922
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে।

ওগো পথিক, তুমি এসে বসবে বারে বারে ॥

ঐ যে তোমার ভোরের পাখি নিত্য করে ডাকাডাকি,

অরুণ-আলোর খেয়ায় যখন এস ঘাটের পারে,

মোর প্রভাতীর গানখানিতে দাঁড়াও আমার দ্বারে ॥

আজ সকালে মেঘের ছায়া লুটিয়ে পড়ে বনে,

জল ভরেছে ঐ গগনের নীল নয়নের কোণে।

আজকে এলে নতুন বেশে তালের বনে মাঠের শেষে,

অমনি চলে যেয়ো নাকো গোপনসঞ্চারে।

দাঁড়িয়ো আমার মেঘলা গানের বাদল-অন্ধকারে ॥


রাগ: কেদার-ছায়ানট
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1322
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1916
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী
===========================================
ও আমার দেশের মাটি, তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা।

তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ॥

তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,

তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,

তোমার ওই শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ॥

ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।

তোমার 'পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।

তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,

তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,

তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা ॥

ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা--

তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!

আমার জনম গেল বৃথা কাজে,

আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে--

তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা ॥


রাগ: পিলু-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
=========================================
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা।

সুন্দর এসে ফিরে যায়, তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা॥

মুখে নাহি নিঃসরে ভাষ, দহে অন্তরে নির্বাক বহ্নি।

ওষ্ঠে কী নিষ্ঠুর হাস, তব মর্মে যে ক্রন্দন তন্বী!

মাল্য যে দংশিছে হায়, তব শয্যা যে কণ্টকশয্যা

মিলনসমুদ্রবেলায় চির- বিচ্ছেদজর্জর মজ্জা॥

রাগ: ভৈরবী-বাউল
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1321
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1914
========================================
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে

মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।

তব ভুবনে তব ভবনে

মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান ॥

আরো আলো আরো আলো

এই নয়নে, প্রভু, ঢালো।

সুরে সুরে বাঁশি পুরে

তুমি আরো আরো আরো দাও তান ॥

আরো বেদনা আরো বেদনা,

প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা।

দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে

মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।

আরো প্রেমে আরো প্রেমে

মোর আমি ডুবে যাক নেমে।

সুধাধারে আপনারে

তুমি আরো আরো আরো করো দান ॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৩ জুন, ১৯১২
রচনাস্থান: লোহিত সমুদ্রবক্ষে জাহাজে
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==========================================
তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।

যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।

যদি থাকি কাছাকাছি,

দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি--

তবু মনে রেখো।

যদি জল আসে আঁখিপাতে,

এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,

তবু মনে রেখো।

এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে-- মনে রেখো।

যদি পড়িয়া মনে

ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে--

তবু মনে রেখো।

রাগ: কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1294
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1887
স্বরলিপিকার: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লকুমার দাস
==============================================

No comments:

Post a Comment