Tuesday 27 August 2013



কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।

মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,

শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।

আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।

আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।

আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।

এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।

এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক।

দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

মাথার 'পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ॥


রাগ: কীর্তন
তাল: অর্ধঝাঁপ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৪ আষাঢ়, ১৩০৭
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৮ জুন, ১৯০০
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।

তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মন, মন রে আমার॥

যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি--

কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন, মন রে আমার॥

নদীর জলে থাকি রে কান পেতে,

কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।

মনে হয় যে পাব খুঁজি ফুলের ভাষা যদি বুঝি,

যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে মন, মন রে আমার॥

রাগ: ভৈরবী-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1321
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1915
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
=========================================
শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়।

ক্ষণে ক্ষণে শর্বরী শিহরিয়া উঠে, হায়॥

তেমনি তোমার বাণী মর্মতলে যায় হানি সঙ্গোপনে,

ধৈরজ যায় যে টুটে, হায়॥

যেমন বরষাধারায় অরণ্য আপনা হারায় বারে বারে

ঘন রস-আবরণে

তেমনি তোমার স্মৃতি ঢেকে ফেলে মোর গীতি

নিবিড় ধারে আনন্দ-বরিষণে, হায়॥

রাগ: মেঘমল্লার
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1346
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
============================================
আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা।

আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা॥

নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে--

বাজে আলো বাজে, ও ভাই হৃদয়বীণার মাঝে--

জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা॥

আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।

আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী।

মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা--

পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি--

সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা॥

রাগ: ইমন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আষাঢ়, ১৩১৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1911
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: ভীমরাও শাস্ত্রী
==============================================
চরণধ্বনি শুনি তব, নাথ, জীবনতীরে

কত নীরব নির্জনে কত মধুসমীরে ॥

গগনে গ্রহতারাচয় অনিমেষে চাহি রয়,

ভাবনাস্রোত হৃদয়ে বয় ধীরে একান্তে ধীরে ॥

চাহিয়া রহে আঁখি মম তৃষ্ঞাতুর পাখিসম,

শ্রবণ রয়েছি মেলি চিত্তগভীরে--

কোন্‌ শুভপ্রাতে দাঁড়াবে হৃদিমাঝে,

ভুলিব সব দুঃখ সুখ ডুবিয়া আনন্দনীরে ॥

রাগ: কাফি
তাল: ঝাঁপতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1314
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1908
স্বরলিপিকার: কাঙ্গালীচরণ সেন
================================================
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে

জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ॥

এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্‌ভ্রান্ত মেঘে মন চায়

মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥

মেঘমল্লার সারা দিনমান।

বাজে ঝরনার গান।

মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা-- মন চায়

মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥

রাগ: কাফি
তাল: ২ + ২ ছন্দ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1346
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
=========================================
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙ্গরসিকতা


রায় চৌধুরী একবার নতুন চশমা পরে কবিগুরুকে দেখাতে এলেন । 
চশমার কাচটা একটু নিলাভ ছিল । তাই সুধাকান্ত বাবু বললেন ,
 “সাদা কাঁচের চেয়ে রঙ্গিন কাঁচই নাকি আমার চোখের পক্ষে উপকারী ” ।
সব শুনে গুরুদেব গম্ভীরভাবে বললেন -”যাক , 
এতদিনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল । স্বয়ং ভগবান তোমাকে যে জিনিস দিতে পারেননি ,
 এখন দেখছি ডাক্তারই তোমাকে সেটা দিলেন ।
============================================

দিব কাঙালিনীর আঁচল তোমার পথে পথে বিছায়ে॥

যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু তারি ফুলে ফুলে হে অতনু,

আমার পূজা-নিবেদনের দৈন্য দিয়ো ঘুচায়ে॥

তোমার রণজয়ের অভিযানে তুমি আমায় নিয়ো,

ফুলবাণের টিকা আমার ভালে এঁকে দিয়ো দিয়ো!

আমার শূন্যতা দাও যদি সুধায় ভরি দিব তোমার জয়ধ্বনি ঘোষণ করি--

ফাল্গুনের আহ্বান জাগাও আমার কায়ে দক্ষিণবায়ে॥

রাগ: খাম্বাজ-কীর্তন
তাল: খেমটা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ফাল্গুন, ১৩৪২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
=========================================

No comments:

Post a Comment