Thursday 22 August 2013

 আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।

তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী॥

তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,

তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।

আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,

আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।

ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে,

আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৫ আশ্বিন, ১৩০২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1895
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী
===========================================
আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে

তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে॥

সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে,

আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে

কাঁপন ভেসে চলে॥

নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন--

দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীন।

তার ছিঁড়ে গেছে কবে একদিন কোন্‌ হাহারবে,

সুর হারায়ে গেল পলে পলে॥

রাগ: কালাংড়া-ভৈরবী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1344
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1937
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
========================================
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,

আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে ॥

দেহমনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে,

গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে ॥

আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,

দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।

বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা--

জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে।

রাগ: মিশ্র কেদারা
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২ আশ্বিন, ১৩৩৩
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬
রচনাস্থান: ন্যুর্নবর্গ, জার্মানী
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=========================================
আমি, জেনে শুনে বিষ করেছি পান।

প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।

যতই দেখি তারে ততই দহি,

আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,

তবু পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি,

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ।

যতই হাসি দিয়ে দহন করে,

ততই বাড়ে তৃষা প্রেমের তরে,

প্রেম-অমৃত-ধারা ততই যাচি,

যতই করে প্রাণে অশনি দান।

রাগ: দেশ
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): অগ্রহায়ণ, ১২৯৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1888
রচনাস্থান: কলকাতা, দার্জিলিং
স্বরলিপিকার: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী
=========================================
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে

পাগল আমার মন জেগে ওঠে॥

চেনাশোনার কোন্‌ বাইরে যেখানে পথ নাই নাই রে

সেখানে অকারণে যায় ছুটে॥

ঘরের মুখে আর কি রে কোনো দিন সে যাবে ফিরে।

যাবে না, যাবে না--

দেয়াল যত সব গেল টুটে॥

বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা কোন্‌ বলরামের আমি চেলা,

আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে--

যত মাতাল জুটে।

যা না চাইবার তাই আজি চাই গো,

যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো।

পাব না, পাব না,

মরি অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে॥

রাগ: বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1346
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
=========================================
আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে।

আমার ভাবনা যত উতল হল অকারণে॥

কেমন ক'রে যায় যে ডেকে, বাহির করে ঘরের থেকে,

ছায়াতে চোখ ফেলে ছেয়ে ক্ষণে ক্ষণে॥

বাঁধনহারা জলধারার কলরোলে

আমারে কোন্‌ পথের বাণী যায় যে ব'লে।

সে পথ গেছে নিরুদ্দেশে মানসলোকে গানের শেষে

চিরদিনের বিরহিণীর কুঞ্জবনে॥

রাগ: মিশ্র মল্লার
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২ আষাঢ়, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৬ জুন, ১৯২২
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
তোমার হল শুরু, আমার হল সারা--

তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা ॥

তোমার জ্বলে বাতি তোমার ঘরে সাথি--

আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা ॥

তোমার আছে ডাঙা, আমার আছে জল--

তোমার বসে থাকা, আমার চলাচল।

তোমার হাতে রয়, আমার হাতে ক্ষয়--

তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা ॥

রাগ: বিলাতি ভাঙা
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৭ চৈত্র, ১৩২২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৯ এপ্রিল, ১৯১৬
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
================================================
তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।

মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই॥

সে-যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা।

সে-যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা।

আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই--

আামি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥

তোরা পাবার জিনিস হাতে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে--

যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে।

আমার যা ছিল তা গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে--

আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস, বুঝি মরি তারি শোকে?

আমি আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই।

আমি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥

রাগ: বেহাগ-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1317
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1910
স্বরলিপিকার: প্রফুল্লকুমার দাস
========================================
তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।

তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মন, মন রে আমার॥

যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি--

কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন, মন রে আমার॥

নদীর জলে থাকি রে কান পেতে,

কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।

মনে হয় যে পাব খুঁজি ফুলের ভাষা যদি বুঝি,

যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে মন, মন রে আমার॥

রাগ: ভৈরবী-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1321
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1915
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
===========================================
তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী,

অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি।

সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে,

সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,

পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে,

বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।

মনে করি অমনি সুরে গাই,

কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই।

কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে;

হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে;

আমায় তুমি ফেলেছ কোন্‌ ফাঁদে

চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি!

রাগ: খাম্বাজ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১০ ভাদ্র, ১৩১৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1909
স্বরলিপিকার: ভীমরাও শাস্ত্রী, এ. এ. বাকে
===========================================
প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে।

ভয়-ভাবনার বাধা টুটেছে ॥

দুঃখকে আজ কঠিন বলে জড়িয়ে ধরতে বুকের তলে

উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে ॥

হেথায় কারো ঠাঁই হবে না মনে ছিল এই ভাবনা,

দুয়ার ভেঙে সবাই জুটেছে।

যতন করে আপনাকে যে রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে,

আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে ॥

রাগ: ভৈরবী-রামকেলী
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৯ ভাদ্র, ১৩২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২৫ অগাস্ট, ১৯১৩
রচনাস্থান: লন্ডন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==========================================
দুজনে দেখা হল মধুযামিনী রে--

কেন কথা কহিল না, চলিয়া গেল ধীরে॥

নিকুঞ্জে দখিনাবায় করিছে হায়-হায়,

লতাপাতা দুলে দুলে ডাকিছে ফিরে ফিরে॥

দুজনের আঁখিবারি গোপনে গেল বয়ে,

দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে।

আর তো হল না দেখা, জগতে দোঁহে একা--

চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনাতীরে॥


রাগ: বেহাগ-খাম্বাজ-কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1291
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1885
স্বরলিপিকার: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী
============================================
কবে তুমি আসবে ব'লে রইব না বসে, আমি চলব বাহিরে।

শুকনো ফুলের পাতাগুলি পড়তেছে খসে, আর সময় নাহি রে॥

বাতাস দিল দোল্‌, দিল দোল্‌;

ও তুই ঘাটের বাঁধন খোল্‌, ও তুই খোল্‌।

মাঝ-নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তরী বাহি রে॥

আজ শুক্লা একাদশী, হেরো নিদ্রাহারা শশী

ওই স্বপ্নপারাবারের খেয়া একলা চালায় বসি।

তোর পথ জানা নাই, নাইবা জানা নাই--

ও তোর নাই মানা নাই, মনের মানা নাই--

সবার সাথে চলবি রাতে সামনে চাহি রে॥

রাগ: কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আষাঢ়, ১৩১৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1911
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==============================================
আমার নিশীথরাতের বাদলধারা, এসো হে গোপনে

আমার স্বপনলোকে দিশাহারা ॥

ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন--

আমি চাই নে তপন, চাই নে তারা ॥

যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে নিয়ো গো, নিয়ো গো,

আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।

একলা ঘরে চুপ চুপে এসো কেবল সুরের রূপে--

দিয়ো গো, দিয়ো গো,

আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া ॥

রাগ: বেহাগ
তাল: কাহারবা-দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১৩২২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): অক্টোবর, ১৯১৫
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==========================================
ওগো সাঁওতালি ছেলে,

শ্যামল সঘন নববরষার কিশোর দূত কি এলে॥

ধানের ক্ষেতের পারে শালের ছায়ার ধারে

বাঁশির সুরেতে সুদূর দূরেতে চলেছ হৃদয় মেলে॥

পুবদিগন্ত দিল তব দেহে নীলিমলেখা,

পীত ধড়াটিতে অরুণরেখা,

কেয়াফুলখানি কবে তুলে আনি

দ্বারে মোর রেখে গেলে॥

আমার গানের হংসবলাকাপাঁতি

বাদল-দিনের তোমার মনের সাথি।

ঝড়ে চঞ্চল তমালবনের প্রাণে

তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি একখানে,

মেঘের ছায়ায় চলিয়াছি ছায়া ফেলে॥


রাগ: মিশ্র ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ভাদ্র, ১৩৪৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
===========================================
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে

তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে ॥

একতারাটির একটি তারে গানের বেদন বইতে নারে,

তোমার সাথে বারে বারে হার মেনেছি এই খেলাতে

তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে ॥

আমার এ তার বাঁধা কাছের সুরে,

ওই বাঁশি যে বাজে দূরে।

গানের লীলার সেই কিনারে যোগ দিতে কি সবাই পারে

বিশ্বহৃদয়পারাবারে রাগরাগিণীর জাল ফেলাতে--

তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে?।


রাগ: খাম্বাজ
তাল: দাদরা-খেমটা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1326
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1919
===========================================
“ভালোবাসা কোনো অধিকারের
মধ্যে কাউকে আটকিয়ে ফেলে না,
বরং তাকে নতুন স্বাধীনতা দান করে।“ 
~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
=========================================

No comments:

Post a Comment