Thursday 22 August 2013



এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায়।

এমন দিনে মন খোলা যায়--

এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে

তপনহীন ঘন তমসায়॥

সে কথা শুনিবে না কেহ আর,

নিভৃত নির্জন চারি ধার।

দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,

আকাশে জল ঝরে অনিবার--

জগতে কেহ যেন নাহি আর॥

সমাজ সংসার মিছে সব,

মিছে এ জীবনের কলরব।

কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে

হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব--

আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥

তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার

নামাতে পারি যদি মনোভার।

শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে

দু কথা বলি যদি কাছে তার

তাহাতে আসে যাবে কিবা কার॥

ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,

বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।

যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে

সে কথা আজি যেন বলা যায়--

এমন ঘনঘোর বরিষায়॥


রাগ: দেশ
তাল: রূপক
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৭ মে, ১৮৮৯
রচনাস্থান: খিরকী, পুনে
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=============================================
ওগো, তোরা কে যাবি পারে।

আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদীকিনারে॥

ও পারেতে উপবনে

কত খেলা কত জনে,

এ পারেতে ধু ধু মরু বারি বিনা রে॥

এই বেলা বেলা আছে, আয় কে যাবি।

মিছে কেন কাটে কাল কত কী ভাবি।

সূর্য পাটে যাবে নেমে,

সুবাতাস যাবে থেমে,

খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে সন্ধ্যা-আঁধারে॥

রাগ: বেহাগ-খাম্বাজ
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1300
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1893
==========================================

আমার মন কেমন করে--

কে জানে, কে জানে, কে জানে কাহার তরে॥

অলখ পথের পাখি গেল ডাকি,

গেল ডাকি সুদূর দিগন্তরে

ভাবনাকে মোর ধাওয়ায়

সাগরপারের হাওয়ায় হাওয়ায় হাওয়ায়।

স্বপনবলাকা মেলেছে পাখা,

আমায় বেঁধেছে কে সোনার পিঞ্জরে ঘরে॥


রাগ: মিশ্র ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১০ অগ্রহায়ণ, ১৩৪৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২৬ নভেম্বর, ১৯৩৮
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
===========================================
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে,

দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি-- পেয়েছি আঁধার রাতে॥

না দেখিবে তারে, পরশিবে না গো, তারি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো--

তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে॥

তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল

বীণাবাদিনীর শতদলদলে করিছে সে টলোমল।

মোর গানে গানে পলকে পলকে ঝলসি উঠিছে ঝলকে ঝলকে,

শান্ত হাসির করুণ আলোকে ভাতিছে নয়নপাতে॥

রাগ: কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): কার্তিক, ১৩৪০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1933
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
============================================
সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে

দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে॥

এ কথা কভু আর পারে না ঘুচিতে,

আছে সে নিখিলের মাধুরীরুচিতে।

এ কথা শিখানু যে আমার বীণারে,

গানেতে চিনালেম সে চির-চিনারে॥

সে কথা সুরে সুরে ছড়াব পিছনে

স্বপনফসলের বিছনে বিছনে।

মধুপগুঞ্জে সে লহরী তুলিবে,

কুকুমকুঞ্জে সে পবনে দুলিবে,

ঝরিবে শ্রাবণের বাদলসিচনে।

শরতে ক্ষীণ মেঘে ভাসিবে আকাশে

স্মরণবেদনার বরনে আঁকা সে।

চকিতে ক্ষণে ক্ষণে পাব যে তাহারে

ইমনে কেদারায় বেহাগে বাহারে॥

রাগ: কানাড়া-পিলু-খাম্বাজ-ভীমপলশ্রী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৮ ফাল্গুন, ১৩৩৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২ মার্চ, ১৯৩০
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে

ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে॥

বাদলপ্রাতের উদাস পাখি ওঠে ডাকি।

বনের গোপন শাখে শাখে, পিছু ডাকে॥

ভরা নদী ছায়ার তলে ছুটে চলে--

খোঁজে কাকে, পিছু ডাকে।

আমার প্রাণের ভিতর সে কে থেকে থেকে

বিদায়প্রাতের উতলাকে পিছু ডাকে॥


রাগ: আশাবরী-ভৈরবী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ভাদ্র, ১৩৩০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1923
===========================================
অনেক কথা যাও যে ব'লে কোনো কথা না বলি।

তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি॥

যে আছে মম গভীর প্রাণে ভেদিবে তারে হাসির বাণে,

চকিতে চাহ মুখের পানে তুমি যে কুতূহলী।

তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি।

আমার চোখে যে চাওয়াখানি ধোওয়া সে আঁখিলোরে--

তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে।

তোমার মনে কুয়াশা আছে, আপনি ঢাকা আপন-কাছে--

নিজের অগোচরেই পাছে আমারে যাও ছলি

তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি॥

রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২১ চৈত্র, ১৩৩২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৪ এপ্রিল, ১৯২৬
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি

আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি ॥

সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারি পিছে গো--

রেখো না আর, বেঁধো না আর কূলের কাছাকাছি ॥

মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা,

ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।

ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রূকুটিতে--

দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি ॥


রাগ: সারিগান
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৭ ভাদ্র, ১৩২১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১৪
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: সুধীরচন্দ্র কর
============================================
আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে

তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে॥

সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে,

আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে

কাঁপন ভেসে চলে॥

নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন--

দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীন।

তার ছিঁড়ে গেছে কবে একদিন কোন্‌ হাহারবে,

সুর হারায়ে গেল পলে পলে॥

রাগ: কালাংড়া-ভৈরবী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1344
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1937
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
===========================================
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,

দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে ॥

পান করি রবে শশী অঞ্জলি ভরিয়া--

সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি--

নিত্য পূর্ণ ধরা জীবনে কিরণে ॥

বসিয়া আছ কেন আপন-মনে,

স্বার্থনিমগন কী কারণে?

চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি,

ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি

প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে ॥


রাগ: মিশ্র মালকোষ
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1300
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1894
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
=============================================
গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে।

ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে যায় ধুলায় রে॥

ও যে আমায় ঘরের বাহির করে, পায়ে-পায়ে পায়ে ধরে--

ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে যায় রে কোন্‌ চুলায় রে।

ও যে কোন্‌ বাঁকে কী ধন দেখাবে, কোন্‌খানে কী দায় ঠেকাবে--

কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে ভেবেই না কুলায় রে॥


রাগ: বাউল
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1316
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1909
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
===============================================
তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে।

আমার যায় বেলা, বয়ে যায় বেলা কেমন বিনা কারণে॥

এই পাগল হাওয়া কী গান-গাওয়া

ছড়িয়ে দিয়ে গেল আজি সুনীল গগনে॥

সে গান আমার লাগল যে গো লাগল মনে,

আমি কিসের মধু খুঁজে বেড়াই ভ্রমরগুঞ্জনে।

ওই আকাশ-ছাওয়া কাহার চাওয়া

এমন ক'রে লাগে আজি আমার নয়নে॥


রাগ: বেহাগ-কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1328
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1921
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে।

আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে ॥

আমার অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,

হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে ॥

আমার লজ্জা যাবে যখন পাব দেবার মতো ধন,

যখন রূপ ধরিয়ে বিকশিবে প্রাণের আরাধন।

আমার বন্ধু যখন রাত্রিশেষে পরশ তারে করবে এসে,

ফুরিয়ে গিয়ে দলগুলি সব চরণে তার লুটবে ॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৩২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১ ডিসেম্বর, ১৯১৩
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
===========================================

No comments:

Post a Comment