Tuesday 20 August 2013



রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে
তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহানার ধারে॥
সেইখানেতে সাদায় কালোয় মিলে গেছে আঁধার আলোয়–
সেইখানেতে ঢেউ ছুটেছে এ পারে ওই পারে॥
নিতলনীল নীরব-মাঝে বাজল গভীর বাণী,
নিকষেতে উঠল ফুটে সোনার রেখাখানি।
মুখের পানে তাকাতে যাই, দেখি-দেখি দেখতে না পাই–
স্বপন-সাথে জড়িয়ে জাগা, কাঁদি আকুল ধারে॥
=========================================
ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু
পথে যদি পিছিয়ে… পিছিয়ে পড়ি কভু

এই যে হিয়া থর থর, কাপে আজি এমন তর
এই বেদনা ক্ষমা কর… ক্ষমা কর… ক্ষমা কর প্রভু।
পথে যদি পিছিয়ে… পিছিয়ে পড়ি কভু

এই দ্বীনতা ক্ষমা কর প্রভু, পিছন পানে তাকাই যদি কভু
দিনের তাপে রোদ্র জ্বালায়, শুকায় মালা পুজার থালায়
সেই মানতা ক্ষমা কর… ক্ষমা কর… ক্ষমা কর প্রভু।
পথে যদি পিছিয়ে… পিছিয়ে পড়ি কভু 
==========================================
আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায়

লুকোচুরি খেলা।

নীল আকশে কে ভাসালে

সাদা মেঘের ভেলা।

আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,

উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে;

আজ কিসের তরে নদীর চরে

চখাচখির মেলা।



ওরে যাব না আজ ঘরে রে ভাই,

যাব না আজ ঘরে।

ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ

নেব রে লুঠ করে।

যেন জোয়ার-জলে ফেনার রাশি

বাতাসে আজ ছুটছে হাসি।

আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি

কাটবে সকল বেলা।
=========================================
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি ।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি ।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি,
আমার হৃদয়-পানে চাই নি ।।
আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে, আমি তোমার কাছে যাই নি ।।
তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায় -
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায় ।
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখসুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি ।
=========================================
সখী, বহে গেল বেলা, শুধু হাসিখেলা, এ কি আর ভালো লাগে।
আকুল তিয়াষ, প্রেমের পিয়াস, প্রাণে কেন নাহি জাগে॥
কবে আর হবে থাকিতে জীবন আঁখিতে আঁখিতে মদির মিলন--
মধুর হুতাশে মধুর দহন, নিতি-নব অনুরাগে॥
তরল কোমল নয়নের জল, নয়নে উঠিবে ভাসি,
সে বিষাদনীরে নিবে যাবে ধীরে প্রখর চপল হাসি।
উদাস নিশ্বাস আকুলি উঠিবে, আশানিরাশায় পরান টুটিবে--
মরমের আলো কপোলে ফুটিবে শরম-অরুণরাগে॥
========================================
তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার,
তাই জনম গেলো শান্তি পেলি নারে মন মনরে আমার।
যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি রে,
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন মনরে আমার!!
নদীর জলে থাকিরে কান পেতে
কাপে যে প্রান পাতার মর্মরেতে।
মনে হয় যে পাবো খুজি ফুলের ভাষা যদি বুঝি রে,
যে পথ গেছে সন্ধ্যা তারার পারে মন মনরে আমার।
=======================================================
আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে ।
বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে ।।
তোমার বুকে বাজল ধ্বনি
বিদায়গাথা আগমনী কত যে-
ফাল্গুনে শ্রাবণে কত প্রভাতে রাতে ।।
যে কথা রয় প্রাণের ভিতর অগোচরে
গানে গানে নিয়েছিল চুরি ক'রে ।
সময় যে তার হল গত
নিশিশেষের তারার মতো,
তারে শেষ করে দাও শিউলিফুলের মরণ-সাথে ।।
=========================================
তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।
ওই-যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়,
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি,
তুমি কি তাদের মত সত্য নও।
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি।।
নয়নসমুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই– আজি তাই
শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।
আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।
নাহি জানি, কেহ নাহি জানে–
তব সুর বাজে মোর গানে,
কবির অন্তরে তুমি কবি–
নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি।
===========================================
ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে ॥
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে--
সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে ॥
আকাশের যত তারা
চেয়ে রয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।
প্রভাতের পথিক সবে
এল কি কলরবে--
গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে ॥
============================================
তারে দেখাতে পারি নে কেন প্রাণ খুলে গো।
কেন বুঝাতে পারি নে হৃদয়বেদনা।।
কেমনে সে হেসে চলে যায়,
কোন্‌ প্রাণে ফিরেও না চায়,
এত সাধ এত প্রেম করে অপমান।।
এত ব্যথাভরা ভালোবাসা কেহ দেখে না-
প্রাণে গোপনে রহিল।
এ প্রেম কুসুম যদি হত
প্রাণ হতে ছিঁড়ে লইতাম,
তার চরণে করিতাম দান।
বুঝি সে নিত না, শুকাত অনাদরে-
তবু তার সংশয় হত অবসান।।
===========================================
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে--

তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে॥

সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ,

সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ--

তুমি জান না, ঢেকে রেখেছি তোমার নাম

রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে॥

তোমার অরূপ মূর্তিখানি

ফাল্গুনের আলোতে বসাই আনি।

বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদূর দিগন্তে

সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী

গানের তানের সে উন্মাদনে॥
==========================================
তুমি রবে নীরবে,
হৃদয়ে মম,
তুমি রবে নীরবে,
নিবিড়, নিভৃত,
পূর্ণিমা নিশীথিনী সম,
তুমি রবে নীরবে।

মম জীবন যৌবন,
মম অখিল ভুবন,
তুমি ভরিবে গৌরবে,
নিশীথিনী-সম।

তুমি রবে নীরবে,
হৃদয়ে মম,
তুমি রবে নীরবে।

জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চল ছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।

জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চল ছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।

মম দুঃখবেদন,
মম সফল স্বপন,
মম দুঃখবেদন,
মম সফল স্বপন,
তুমি ভরিবে সৌরভে,
নিশীথিনী সম।

তুমি রবে নীরবে,
হৃদয়ে মম,
তুমি রবে নীরবে,
নিবিড় নিভৃত,
পূর্ণিমা নিশীথিনী সম,
তুমি রবে নীরবে॥
==========================================
আমার পরান যাহা চায়,

তুমি তাই, তুমি তাই গো।

তোমা ছাড়া আর এ জগতে

মোর, কেহ নাই কিছু নাই গো।

তুমি সুখ যদি নাহি পাও,

যাও, সুখের সন্ধানে যাও,

আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে,

আর কিছু নাহি চাই গো।

আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,

তোমাতে করিব বাস,

দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,

দীর্ঘ বরষ মাস।

যদি আর কারে ভালোবাস,

যদি আর ফিরে নাহি আস,

তবে, তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও,

আমি যত দুখ পাই গো।
=========================================
আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে--

এই নিরালায় রব আপন কোণে।

যাব না এই মাতাল সমীরণে ॥

আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥

রাগ: বেহাগ
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২২ চৈত্র, ১৩২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1914
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,

আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান॥

মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে

এই-যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান॥

আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল--

রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।

এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে

ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান॥


রাগ: মল্লার
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৪ শ্রাবণ, ১৩৪৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৩০ জুলাই, ১৯৩৯
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
==========================================
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে

জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ॥

এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্‌ভ্রান্ত মেঘে মন চায়

মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥

মেঘমল্লার সারা দিনমান।

বাজে ঝরনার গান।

মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা-- মন চায়

মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥

রাগ: কাফি
তাল: ২ + ২ ছন্দ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1346
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
============================================
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।

ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥

পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে--

ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো ॥

নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা,

বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা।

পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায়, শশী, ছড়াও কী এ।

ইন্দ্রপুরীর কোন্‌ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো ॥

রাগ: পিলু
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1336
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1929
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=============================================
একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি--

তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী।

কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,

তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি॥

যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে

চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।

যেটুকু যায় রে দূরে ভাবনা কাঁপায় সুরে,

তাই নিয়ে যায় বেলা নূপুরের তাল গুনি॥

রাগ: কালাংড়া
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২ ফাল্গুন, ১৩৩৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।

তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী॥

তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,

তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।

আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,

আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।

ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে,

আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৫ আশ্বিন, ১৩০২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1895
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী
============================================
আমার নিশীথরাতের বাদলধারা, এসো হে গোপনে

আমার স্বপনলোকে দিশাহারা ॥

ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন--

আমি চাই নে তপন, চাই নে তারা ॥

যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে নিয়ো গো, নিয়ো গো,

আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।

একলা ঘরে চুপ চুপে এসো কেবল সুরের রূপে--

দিয়ো গো, দিয়ো গো,

আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া ॥

রাগ: বেহাগ
তাল: কাহারবা-দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১৩২২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): অক্টোবর, ১৯১৫
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================

No comments:

Post a Comment