Thursday 22 August 2013


স্বপন-পারের ডাক শুনেছি, জেগে তাই তো ভাবি--

কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি॥

নয় তো সেথায় যাবার তরে, নয় কিছু তো পাবার তরে,

নাই কিছু তার দাবি--

বিশ্ব হতে হারিয়ে গেছে স্বপ্নলোকের চাবি॥

চাওয়া-পাওয়ার বুকের ভিতর না-পাওয়া ফুল ফোটে,

দিশাহারা গন্ধে তারি আকাশ ভরে ওঠে।

খুঁজে যারে বেড়াই গানে, প্রাণের গভীর অতল-পানে

যে জন গেছে নাবি,

সেই নিয়েছে চুরি করে স্বপ্নলোকের চাবি॥

রাগ: কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৯ বৈশাখ, ১৩৩৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২২ এপ্রিল, ১৯২৮
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
=======================================
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,

চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,

মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে--

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।



যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,

কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা,

ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,

শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়--

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।



তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,

কাটবে দিন কাটবে,

কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে, আহা,

ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সে দিন উঠবে ভরি--

চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।



তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি-- আহা,

নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে॥

রাগ: বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৫ চৈত্র, ১৩২২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৭ এপ্রিল, ১৯১৬
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
বেদনা কী ভাষায় রে

মর্মে মর্মরি গুঞ্জরি বাজে॥

সে বেদনা সমীরে সমীরে সঞ্চারে,

চঞ্চল বেগে বিশ্বে দিল দোলা ॥

দিবানিশা আছি নিদ্রাহারা বিরহে

তব নন্দনবন-অঙ্গনদ্বারে,

মনোমোহন বন্ধু--

আকুল প্রাণে

পারিজাতমালা সুগন্ধ হানে॥


রাগ: আশাবরী (দক্ষিণী)
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1337
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1931
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
==============================================
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।

মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,

শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।

আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।

আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।

আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।

এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।

এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।



কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক।

দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

মাথার 'পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ॥


রাগ: কীর্তন
তাল: অর্ধঝাঁপ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৪ আষাঢ়, ১৩০৭
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৮ জুন, ১৯০০
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
============================================
তুমি কোন্‌ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।

আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে॥

আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে,

বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে॥

তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার, মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে--

ছিন্ন যবে হল তার ফেলে গেলে ভূমি-'পরে।

নীরব তাহারি গান আমি তাই জানি তোমারি দান--

ফেরে সে ফাল্গুন-হাওয়ায়-হাওয়ায় সুরহারা মূর্ছনাতে॥

রাগ: কাফি-কানাড়া
তাল: ২ + ২ ছন্দ
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৭ আষাঢ়, ১৩৪৬
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১২ জুলাই, ১৯৩৯
রচনাস্থান: শ্রীনিকেতন
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
==========================================
তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ

ও মোর ভালোবাসার ধন।

দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

ওগো তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার চিরকালের--

ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি ভয়ে কাঁপে মন--

প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।

তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে,

ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২০ ফাল্গুন, ১৩২১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৩ মার্চ, ১৯১৫
রচনাস্থান: সুরুল
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
==============================================
সেই ভালো সেই ভালো, আমারে নাহয় না জানো।

দূরে গিয়ে নয় দুঃখ দেবে, কাছে কেন লাজে লাজানো ॥

মোর বসন্তে লেগেছে তো সুর, বেণুবনছায়া হয়েছে মধুর--

থাক-না এমনি গন্ধে-বিধুর মিলনকুঞ্জ সাজানো।

গোপনে দেখেছি তোমার ব্যাকুল নয়নে ভাবের খেলা।

উতল আঁচল, এলোথেলো চুল, দেখেছি ঝড়ের বেলা।

তোমাতে আমাতে হয় নি যে কথা মর্মে আমার আছে সে বারতা--

না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা আমার বাঁশিটি বাজানো ॥

রাগ: খাম্বাজ
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): চৈত্র, ১৩৩২
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1926
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=============================================
যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।

কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম॥

কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে, ফিরি আমি কাহার পিছে--

সব যেন মোর বিকিয়েছে, পাই নি তাহার দাম॥

এই বেদনার ধন সে কোথায় ভাবি জনম ধ'রে।

ভুবন ভরে আছে যেন, পাই নে জীবন ভরে।

সুখ যারে কয় সকল জনে বাজাই তারে ক্ষণে ক্ষণে--

গভীর সুরে "চাই নে' "চাই নে' বাজে অবিশ্রাম॥

রাগ: রামকেলী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১২ ফাল্গুন, ১৩২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৪
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
========================================
ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্‌গুনিয়ে।

আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥

আলোতে কোন্‌ গগনে মাধবী জাগল বনে,

এল সেই ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে।

সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।

কেমনে রহি ঘরে, মন যে কেমন করে,

কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।

কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে,

বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে।

আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥

রাগ: কালাংড়া
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আষাঢ়, ১৩১৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1911
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
============================================
তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি।

কেউ কি তা জানে॥

তোমার আছে গানে গানে গাওয়া,

আমার কেবল চোখে চোখে চাওয়া--

মনে মনে মনের কথাখানি বলে এসেছি কেউ কি তা জানে॥

ওদের নেশা তখন ধরে নাই,

রঙিন রসে প্যালা ভরে নাই।

তখনো তো কতই আনাগোনা,

নতুন লোকের নতুন চেনাশোনা--

ফিরে ফিরে ফিরে-আসার আশা দ'লে এসেছি কেউ কি তা জানে॥

রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৬ ফাল্গুন, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১০ মার্চ, ১৯২৩
রচনাস্থান: লক্ষ্নৌ (বোম্বাই যাবার পথে)
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
===========================================
তার হাতে ছিল হাসির ফুলের হার কত রঙে রঙ-করা।

মোর সাথে ছিল দুখের ফলের ভার অশ্রুর রসে ভরা ॥

সহসা আসিল, কহিল সে সুন্দরী 'এসো-না বদল করি'।

মুখপানে তার চাহিলাম, মরি মরি, নিদয়া সে মনোহরা ॥

সে লইল মোর ভরা বাদলের ডালা, চাহিল সকৌতুকে।

আমি লয়ে তার নব ফাগুনের মালা তুলিয়া ধরিনু বুকে।

'মোর হল জয়' যেতে যেতে কয় হেসে, দূরে চলে গেল ত্বরা।

সন্ধ্যায় দেখি তপ্ত দিনের শেষে ফুলগুলি সব ঝরা ॥

রাগ: দেশ-মল্লার
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৪ মাঘ, ১৩৩১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৭ জানুয়ারি, ১৯২৫
রচনাস্থান: দক্ষিন আমেরিকা থেকে ইতালি যাবার পথে
============================================
গোপন কথাটি রবে না গোপনে,

উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।

না না না, রবে না গোপনে॥

বিভল হাসিতে

বাজিল বাঁশিতে,

স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে--

না না না, রবে না গোপনে॥

মধুপ গুঞ্জরিল,

মধুর বেদনায় আলোক-পিয়াসি

অশোক মুঞ্জরিল।

হৃদয়শতদল

করিছে টলমল

অরুণ প্রভাতে করুণ তপনে।

না না না, রবে না গোপনে॥
রাগ: কালাংড়া
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1345
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
==========================================
তার বিদায়বেলার মালাখানি আমার গলে রে

দোলে দোলে বুকের কাছে পলে পলে রে॥

গন্ধ তাহার ক্ষণে ক্ষণে জাগে ফাগুনসমীরণে

গুঞ্জরিত কুঞ্জতলে রে॥

দিনের শেষে যেতে যেতে পথের 'পরে

ছায়াখানি মিলিয়ে দিল বনান্তরে।

সেই ছায়া এই আমার মনে, সেই ছায়া ওই কাঁপে বনে,

কাঁপে সুনীল দিগঞ্চলে রে॥

রাগ: ভীমপলশ্রী-মূলতান
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ভাদ্র, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1922
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
=============================================
যখন এসেছিলে অন্ধকারে

চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে॥

হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম অনুভবে--

গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে॥

তুমি গেলে যখন একলা চলে

চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।

তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার পড়ে আছে--

বুঝেছিলেম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে॥

রাগ: পিলু-বারোয়াঁ
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৬ পৌষ, ১৩৩০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১ জানুয়ারি, ১৯২৪
রচনাস্থান: শ্রীনিকেতন
===========================================
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে

আমার নামটি লিখো-- তোমার

মনের মন্দিরে।

আমার পরানে যে গান বাজিছে

তাহার তালটি শিখো-- তোমার

চরণমঞ্জীরে॥

ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে

আমার মুখর পাখি-- তোমার

প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥

মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো

আমার হাতের রাখী-- তোমার

কনককঙ্কণে॥

আমার লতার একটি মুকুল

ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-- তোমার

অলকবন্ধনে।

আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে

একটি বিন্দু এঁকো-- তোমার

ললাটচন্দনে।

আমার মনের মোহের মাধুরী

মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-- তোমার

অঙ্গসৌরভে।

আমার আকুল জীবনমরণ

টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো-- তোমার

অতুল গৌরবে॥


রাগ: কীর্তন
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৮ আশ্বিন, ১৩০৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1897
রচনাস্থান: সাজাদপুর
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
============================================

No comments:

Post a Comment